
দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতি, জনবল সঙ্কট, যান্ত্রিক ত্রুটি, রেলওয়ের সংস্কার না হওয়াসহ নানা কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে আরামের ও স্বাচ্ছন্দের ট্রেন ভ্রমণ। মেরমতের অভাবে রেলওয়েতে ঝুঁকির মাত্রা দিনদিন ভয়াবহ হচ্ছে। বাড়ছে ট্রেন দুর্ঘটনা। হতাহত হচ্ছে মানুষ। ট্রেন ভ্রমণে এখন যেন দুর্ভোগের শেষ নেই। এরই ধারাবাহিকতায় এবার সিলেটের কুলাউড়ায় ঘটেছে এই ট্রেন দুর্ঘটনা। আগামীতে বড় ধরণের ট্রেন দুর্ঘটনার আশঙ্কা করা হচ্ছে। রোববার মধ্যরাতে
ঢাকা-সিলেট রেলওয়ের কুলাউড়া রেলওয়ে স্টেশনের কাছে এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহতসহ দু’শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছে। হতাহতদের উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে নেয় পুলিশ ও দমকল বাহিনীর কর্মীরা। তবে স্থানীয়রা বলছেন অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন শত শত ট্রেনযাত্রী। এ ঘটনার পর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সিলেটবাসীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দুর্ভোগে পড়েন সিলেটবাসী।
বাংলাদেশের রেলওয়ের অবস্থা যে কতটা বেহাল তা আবারও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ঘটে যাওয়া মধ্যরাতের এই ট্রেন দুর্ঘটনা। গত রোববার মধ্যরাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল স্টেশনের পাশে একটি ব্রিজ ভেঙে খালে ছিটকে পড়ে ঢাকাগামী উপবন এঙ্প্রেসের ৪টি বগি। এসময় ৬ জন নিহত ও শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন বলে পুলিশ সুপার মো. শাহজালাল দৈনিক জনতাকে নিশ্চিত করেছেন। এই দুর্ঘটনা বৃহত্তর সিলেটের সাথে গোটা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পড়ে। দীর্ঘ ১২ ঘণ্টার পর গতকাল সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সিলেটের সাথে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বন্ধ হওয়া রেল যোগাযোগ শুরু হয়েছে। তবে বরমচালে রেললাইন মেরামত না হওয়া পর্যন্ত সিলেটের সব ট্রেন কুলাউড়া থেকে চলাচল করবে বলে রেলওয়ের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। উক্ত ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে এই ট্রেন দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। গত ১৮ জুন থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুরে তিতাস নদীর সেতুর স্প্যান ভেঙে যাওয়ায় রাজধানী ঢাকার সাথে সড়ক পথে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সপ্তাহজুড়ে সীমাহীন দুর্ভোগকে সঙ্গী করেই স্বল্প পরিসরে মানুষজন চলাচল করে আসছিলেন। এর মধ্যে একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল ছিল রেল। তাও গত রোববার রাত ১২টার দিকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল স্টেশনের পাশে একটি ব্রিজ ভেঙে উপবন এঙ্প্রেসের ৪টি বগি খালে ছিটকে পড়ে। রেল দুর্ঘটনার পরপরই গোটা দেশের সাথে বৃহত্তর সিলেট পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সিলেট বিভাগসহ আশপাশের দুই কোটি মানুষের জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। বিশেষ করে বিদেশগামী যাত্রী, অসুস্থ যাত্রী, চাকরিজীবী ও পর্যটকরা বেশি বিপাকে পড়েন।
রেল দুর্ঘটনার খবর পেয়ে গত রোববার রাত ৩টার দিকে ৪৬-বিজিবি শ্রীমঙ্গলের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহ জাহান আলীর নেতৃত্বে ৩০ জনের একটি টিম রেল দুর্ঘটনায় হতাহতদের উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। তারা পুলিশ ও দমকল বাহিনীর সদস্যদের উদ্ধার অভিযানে সহযোগিতা করেন। তারা প্রায় শতাধিক ব্যক্তিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। রেল সচিব মোফাজ্জল হোসেন দৈনিক জনতাকে বলেন, রেল দুর্ঘটনায় ৬ জন মারা গেছেন। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ৬৭ জন। তাদের মধ্যে ২২ জন সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বাকীদের মধ্যে অধিকাংশই হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন। উদ্ধার কাজ শেষ হয়েছে। ১২ ঘণ্টার পর অর্থাৎ গতকাল সোমবার সাড়ে ১২টার দিকে সিলেট-ঢাকা রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। তবে ঢাকা থেকে কুলাউড়া পর্যন্ত ট্রেন চলাচল সচল রাখা হয়েছে। রেল দুর্ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। যার একটি চার সদস্যের। এই কমিটির প্রধান করা হয়েছে রেলওয়ের চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পূর্বাঞ্চল) মো. মিজানুর রহমানকে। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উয়ারদৌস হাসান দৈনিক জনতাকে জানান, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস হতাহতদের উদ্ধারে কাজ করে। ট্রেনের অন্য যাত্রীদেরও নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেয়ার কাজ করেছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সিলেটের সহকারী পরিচালক মুজিবুর রহমান দৈনিক জনতাকে বলেন, হতাহতদের উদ্ধার সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমা ও সিলেট সদর দফতর থেকে দমকল বাহিনীর একাধিক ইউনিট উদ্ধার তৎপরতায় যোগ দেয়। উদ্ধার অভিযান শেষ হয়েছে।
তবে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানিয়েছেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অব্যবস্থাপনার কারণে রেলের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ায় মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা ও সিলেটের মধ্যে রেল ও সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক হবে। মন্ত্রী বলেছেন, মানুষ হুমড়ি খেয়ে রেলে ওঠে। তাই এই দুর্ঘটনা। রেল সচিব মো. মোফাজ্জল হোসেন ঘটনাস্থলে আছেন। ঢাকা থেকে সামগ্রিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। আহতদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। দ্রুতই ঢাকা ও সিলেটের যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হবে।
উল্লেখ্য, গত রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল রেলক্রসিং এলাকার কাছেই সেতু ভেঙে আন্তঃনগর ‘উপবন এঙ্প্রেস’ ট্রেনের ৪টি বগি খালে পড়ে যায়। এছাড়া আরও তিনটি বগি স্থলভাগের সীমানায় লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। মোট ৭টি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্ঘটনার পর উদ্ধার অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট কাজ করে। পুলিশ, বিজিবি ও স্থানীয় লোকজনও উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়।
জানা গেছে, রাজধানীসহ সারাদেশে ২২ লাখ ঘনফুট পাথর থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ৮ থেকে ১০ লাখ ঘনফুট। লাইনের ইলাস্টিক রেল ক্লিপ (প্যান্ডেল), নাট-বল্টু চুরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। রেলের একটি সূত্র বলছে, প্রতি বছর ক্লিপ-ই চুরি যাচ্ছে ৫ লাখ পিস, টাকার অংকে এর পরিমাণ ১০ কোটি টাকা। কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত রেল লাইনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে (জোড়া) হুক খোলা দেখতে পাওয়া যায়। সূত্র বলছে, যথাযথ মেইনটেন্যান্স না করার কারণে প্রতি মাসে ৯০-১২০টির মতো ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে।
রেলপথ প্রকৌশল বিভাগ ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ৭৫ শতাংশ ট্রেন লাইনচ্যুত হয় যথাযথভাবে লাইন মেইনটেন্যান্স না করার কারণে। অথচ লাইনে পাথর দেয়ার জন্য বছরে ৩৩ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে রেলের। লাইনচ্যুত বগি ও ইঞ্জিন উদ্ধার এবং লাইন মেরামতে বছরে ব্যয় হচ্ছে ৯৬ কোটি টাকা।
সূত্র আরো জানায়, এসব দুর্ঘটনায় রেলওয়ের কোটি কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে ট্রেন যাত্রী তথা সাধারণ মানুষও হতাহত হচ্ছেন। দুর্ঘটনার কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ট্রেন পরিচালনায় চালক ও গার্ডস্বল্পতা রয়েছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে ট্রেন চালানো হচ্ছে। অধিকাংশ সময়ে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে চালক, গার্ড, স্টেশন মাস্টারসহ সংশ্লিষ্টদের ভুলের কারণে। মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালানোর কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে।
রেলওয়ে অপারেশন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে রেলওয়েতে যেসব চালক, গার্ড ও স্টেশন মাস্টার রয়েছেন তাদের ৪০ শতাংশই চুক্তিভিত্তিতে নেয়া। চুক্তিভিত্তিতে নেয়া চালক, গার্ড ও স্টেশন মাস্টারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে চালক ও গার্ডদের অভিযোগ, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন ও বগির কারণে ট্রেন দুর্ঘটনা বাড়ছে। লাইনে পাথর না থাকা, সিগন্যাল ব্যবস্থার ত্রুটি, লাইন ক্ষয়, সিস্নপার নষ্ট, লাইন ও সিস্নপার সংযোগস্থলে লোহার হুক না থাকায় দুর্ঘটনা বেড়েছে। দুর্ঘটনা ঘটলেই দায় এড়াতে তাদের কাউকে কাউকে লোক দেখানো সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। যা কিছুদিন পরেই স্বাভাবিক হয়ে যায়।
গার্ড ও চালকরা জানান, সিগন্যাল ব্যবস্থাতে যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে। ট্রেন চলাচলে লাইন ও সিগন্যাল সঠিক থাকা খুবই জরুরি। লাইনে পাথর নেই, সিস্নপার নষ্ট, গজের পর গজ লোহার হুক নেই। ফলে ট্রেন ঘন ঘন লাইনচ্যুত হচ্ছে। বর্তমানে রেলওয়েতে থাকা ইঞ্জিন ও বগির প্রায় ৮০ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ।
রেলের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বছরে কমপক্ষে ৫ লাখের বেশি ক্লিপ চুরি বা ভেঙে গেলেও এর মধ্যে ২ থেকে সোয়া দুই লাখ ক্লিপ সরবরাহ করা হয়। সাপ্লাই দেয়া এসব ক্লিপের সব লাগানোও হয় না। ফলে বছরের পর বছর ক্লিপবিহীন লাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল করে। এসব ক্লিপে ‘বিআর’ (বাংলাদেশ রেলওয়ে) লেখা থাকলে চুরি রোধ করা অনেকাংশে সহজ হতো। একটি ক্লিপ বাইরে ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ক্লিপ চুরির কথা স্বীকার করে ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি মো. ইয়াছিন ফারুক বলেন, বর্তমানে চুরির ঘটনা কমে এসেছে। তবে লাইনে পাথর আছে কিনা কিংবা যন্ত্রাংশ খোলা রয়েছে কিনা তা রেল পুলিশের দেখার কথা নয়। লাইন পাহারায় পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ ও আধুনিক ক্লিপ লাগানো নিশ্চিত করা গেলে এসব চুরি রোধ করা সম্ভব।
রেল পরিদর্শক (জিআইবিআর) আক্তারুজ্জামান জানান, মাঠপর্যায়ে রেলপথের অবস্থা খুবই করুণ। আমরা যতবারই লাইন পরিদর্শন করেছি, ততবারই সমস্যার কথা বলেছি। কিন্তু সমস্যা সমাধান করবে তো সংশ্লিষ্টরা। অনেক স্টেশন বন্ধ। ওই সব স্টেশনের আশপাশ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
রেলের এ দুর্দশা নিয়ে রেল বিভাগের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, রেল হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ বাহন। সরকার রেলের উন্নয়নে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তা সম্পূর্ণ হলে বদলে যাবে রেল। কিন্তু মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাফিলতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, লাইনে প্রয়োজনীয় পাথর থাকবে না, ক্লিপ, নাট-বল্টু খোলা থাকবে এটা কি করে সম্ভব।