বুধবার , ফেব্রুয়ারি ১৯ ২০২৫
Home / সারা দেশ / পানি আসছে কম, ডুবছে বেশি

পানি আসছে কম, ডুবছে বেশি

নাদিরা খানম তুলি, স্টাফ রিপোর্টারঃ

চার বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র নদের পানির উচ্চতা বেড়েই চলেছে। এবার দেশের মধ্যাঞ্চল জামালপুরের বাহাদুরাবাদে ব্রহ্মপুত্রের পানি এতটাই বেড়েছে, যা ১০০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের বন্যার পানি বৃদ্ধি ১৯৮৮ সালের বন্যাকেও হার মানাচ্ছে। যদিও ওই বন্যার তুলনায় এবার উজান থেকে পানি কম এসেছে। কিন্তু বন্যার বিস্তৃতি ও স্থায়িত্ব বেড়েছে। এ সময়ে সাধারণ বন্যার স্থায়িত্ব ৮ থেকে ১২ দিন থাকে। এবার তা এরই মধ্যে দুই সপ্তাহ অতিক্রম করেছে। আরও এক সপ্তাহ এই পানি থাকতে পারে।

নদী গবেষক এবং সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ বলছে, ১৯৮৮, ১৯৯৮,২০০৪ ও ২০১৪ সালের বন্যা বাংলাদেশের বড় বন্যা হিসেবে পরিচিত। ওই বছরগুলোতে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পানি এসেছিল ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ কিউমেক। কিন্তু এ বছর গত বৃহস্পতিবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) হিসাবে ৬৫ হাজার কিউমেক পানি এসেছে। অথচ বন্যায় আক্রান্ত এলাকা ও পানির উচ্চতা ১৯৮৮ সালের চেয়ে এবার বেশি। অর্থাৎ উজান থেকে পানি আসছে কম, ডুবছে বেশি এলাকা।

এ বিষয়ে পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সাইফুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ব৶ হ্মপুত্র অববাহিকার নদীগুলোর তলদেশে পলির উচ্চতা বাড়ছে। এর ফলে বন্যার পানির উচ্চতাও বাড়ছে।

এরই মধ্যে ব৶ হ্মপুত্র অববাহিকার কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলে বন্যা পরিস্থিতি তীব্র। আজ শনিবারের মধ্যে আরও চারটি জেলা শরীয়তপুর, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে বন্যার পানি বিস্তৃত হতে পারে। আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চলেও পানি চলে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। তবে সিলেট ও রাজশাহী বিভাগের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে, পানি নামতে শুরু করেছে। যদিও এসব জেলার নদীতীরবর্তী এলাকায় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুরের বিভিন্ন স্থানে রেললাইন তলিয়ে গেছে, কোথাও কোথাও ভেসে গেছে। এসব স্থান দিয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে। বিকল্প পথে ট্রেন চলছে। বন্যায় গতকাল শুক্রবার সারা দেশে মোট সাতজন মারা গেছেন।

গতকাল আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চলমান বন্যায় বাংলাদেশের ৪০ লাখ মানুষ খাদ্য ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে গেছে। বন্যা এলাকায় ইতিমধ্যে নানা রোগবালাই দেখা দিয়েছে। ৬৬ হাজার ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক এলাকায় সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন আছে। এ ছাড়া শিশুবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের হিসাবে ইতিমধ্যে চার লাখ শিশু বন্যার ঝুঁকিতে পড়েছে।

১৯৮৮ সালের বন্যার চেয়ে ব্রহ্মপুত্রের উজান থেকে পানি ৩৬% কম এসেছে পলিতে নদীর তলদেশ উঁচু হওয়ায় পানির উচ্চতা বেশি ১৭টি জেলায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে শরীয়তপুর, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে বন্যার পানি আসতে পারে আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে ঢাকার নিম্নাঞ্চলেও পানি আসতে পারে

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত বুধবার ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে পানির উচ্চতা ২১ দশমিক ১৬ মিটারে পৌঁছায়। আর তিস্তায় পানি একই দিন ৫৩ দশমিক ১২ মিটার পর্যন্ত পৌঁছায়। এর আগে ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে পানির উচ্চতা পৌঁছেছিল ২০ দশমিক ৬২ মিটারে। কিন্তু ওই বন্যার সময় উজান থেকে আসা পানির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২ হাজার কিউমেক (এক কিউমেক মানে প্রতি সেকেন্ডে এক ঘনমিটার পানির প্রবাহ)। আর এবার উজানের পানির পরিমাণ ৬৫ হাজার কিউমেক হলেও পানির উচ্চতা ২১ দশমিক ১৬ মিটারে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা অববাহিকায় পানির উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে একটি গবেষণা করছেন। তাতে দেখা গেছে, উজান থেকে আসা পানি মূলত ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দুটি চ্যানেল দিয়ে প্রবাহিত হতো। ওই পানি বিভিন্ন শাখানদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ত। ব্রহ্মপুত্রের উজানের দেশ চীন, ভারত ও ভুটানে জুন মাসে বৃষ্টি বেড়ে গিয়ে ওই পানি বাংলাদেশে আসত। কুড়িগ্রাম থেকে গাইবান্ধা হয়ে, বগুড়া-সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ পর্যন্ত ওই বন্যার পানি বিস্তৃত হতো। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার একটি চ্যানেলের নাব্যতা অনেক কমে গেছে।

চলমান গবেষণায় আরও দেখা গেছে, উজান থেকে আসা পলি অপসারণ করা অর্থাৎ নদী খনন করে নাব্যতা বাড়ানোর কাজটি দ্রুততার সঙ্গে হয়নি। ফলে ব্রহ্মপুত্রের একটি চ্যানেল ও তিস্তা অববাহিকার লালমনিরহাট অংশে অনেক শাখানদী পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। এতে বন্যার পানি দ্রুত নদীর দুই কূল ছাপিয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে।

এ ব্যাপারে অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৮৮ সালের বন্যার পর দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের নদীগুলোর পাড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও নানা অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। আর বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ার পর যমুনা নদীর মধ্যে জমা হওয়া পলি অপসারণ বা খনন খুব বেশি করা হয় না। ফলে একদিকে এসব নদীর তলদেশ পলি পড়ে উঁচু হয়ে গেছে, অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও তিস্তা অববাহিকার দুই পাশে যেসব ছোট শাখানদী ছিল, সেগুলোর বেশির ভাগ ভরাট হয়ে গেছে। সেতুসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণের ফলে এসব নদীর পানি ধারণক্ষমতাও কমে গেছে, যে কারণে আগের চেয়ে উজান থেকে পানি কম এলেও বন্যার পানির উচ্চতা দ্রুত বাড়ছে। একই সঙ্গে বন্যার বিস্তৃতি ও স্থায়িত্বও বাড়ছে।

About admin

Check Also

কুড়িগ্রামে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেত্রী দোলা গ্রেফতার

আতিকুর রহমান রানা , কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপকমিটির সম্পাদক দোলনা …

পনের বছরেও তিস্তার একফোঁটা  পানি আনতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার  —–মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর 

আব্দুল কুদ্দুছ বসুনিয়া, বিশেষ প্রতিনিধি কাউনিয়া(রংপুর)খেকে: বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিগত ১৫ …

চিলমারীতে সাবেক যুবলীগ নেতা গ্রেফতার

চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি: কুড়িগ্রামের চিলমারীতে উপজেলা যুব লীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *