
‘সম্ভাবনায়ময় পর্যটনশিল্প’ কথাটি যেন প্রবাদে পরিণত হয়েছে। এ খাতের সম্ভাবনা কখনোই সাফল্যে রূপ নেয়নি। যথাযথ পরিকল্পনা, পর্যাপ্ত বরাদ্দ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দক্ষ জনবল, ব্যাপক প্রচারণা ও কার্যকর সমন্বয় না থাকার কারণে শিল্প ঘোষণার দুই যুগ পরও কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি পর্যটন খাত। এমন বাস্তবতায় প্রথমবারের মতো পর্যটন মহাপরিকল্পনা, ট্যুর অপারেটর আইন, পর্যটন করপোরেশন আইন ও পর্যটক পরিসংখ্যান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। একই সময়ে সরকারের অনেকগুলো ইতিবাচক উদ্যোগ পর্যটনের কাঠামোগত উন্নয়নে নতুন মাইলফলক হবে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। গৃহীত উদ্যোগগুলো আলোর মুখ দেখলে অন্ধকারে থাকা পর্যটনের সম্ভাবনার দ্যুতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে বলে আশা তাদের। একই সঙ্গে পর্যটন খাতে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘ভবিষ্যতের উন্নয়নে, কাজের সুযোগ পর্যটনে’ প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আগামীকাল শুক্রবার বাংলাদেশেও পালিত হবে বিশ্ব পর্যটন দিবস।
এ প্রসঙ্গে বিমান ও পর্যটন সচিব মহিবুল হক জানান, মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ জন্য কমপক্ষে দুই বছর সময় লাগবে। একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে পর্যটক পরিসংখ্যানের জন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ-সংক্রান্ত পরবর্তী সভা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে। ট্যুর অপারেটর আইন ও পর্যটন করপোরেশন আইন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এগুলো শিগগিরই মন্ত্রিসভায় উঠবে। তিনি বলেন, গৃহীত সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগগুলো যাতে দ্রুত বাস্তবায়িত হয়, সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবে মন্ত্রণালয়।
১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ অনুযায়ী গোড়াপত্তন হয় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের (বিপিসি)। দীর্ঘ সময় পর ১৯৯২ সালে প্রণীত জাতীয় পর্যটন নীতিমালায় প্রথমবারের মতো শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় পর্যটনকে। বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সে নীতিমালা হালনাগাদ করে আরও যুগোপযোগী করা হয় ২০১০ সালে। দীর্ঘ সময় পেরোলেও নীতির গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো এখনও উপেক্ষিত। এ নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, ‘পর্যটনশিল্প উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন; দীর্ঘ, মধ্য ও স্বল্প মেয়াদে কর্মপরিকল্পনা ও কৌশলপত্র প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; জাতীয়, আঞ্চলিক ও এলাকাভিত্তিক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন।’ নীতিমালার লক্ষ্যের প্রতি খেয়াল রেখে এখন পর্যন্ত কোনো মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়নি। তবে দীর্ঘদিন পর এ ব্যাপারে গৃহীত উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছেন পর্যটন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ রাশিদুল হাসান সমকালকে বলেন, ‘মহাপরিকল্পনা একটি ব্যাপকভিত্তিক কাজ। এটিসহ অন্য যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়েছে, সবক’টি বাস্তবায়ন হলে নিঃসন্দেহে পর্যটনশিল্প এগিয়ে যাবে। তবে যে কোনো কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি খুব জরুরি। এগুলো ঠিক থাকলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন যথাযথ হবে।’
ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল ট্যুরসের নির্বাহী পরিচালক মাসুদ হোসেন বলেন, ‘গৃহীত উদ্যোগগুলো খুবই ইতিবাচক। দীর্ঘদিন ধরে এসব বিষয়ে দাবি জানিয়ে আসছি। তবে এর আগেও পর্যটন মাস্টারপ্ল্যান, পর্যটক পরিসংখ্যানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। কর্মকর্তা পরিবর্তন হলে উদ্যোগগুলো অন্ধকারে চলে যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন ও মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের ক্ষেত্রে পর্যটন একটি বড় নিয়ামক হতে পারে। এর মাধ্যমে বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান হবে। সে ক্ষেত্রে এবারের প্রতিপাদ্যও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে।’
পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন :বিগত সময়ে কোনো ধরনের মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) ছাড়াই পর্যটন খাতের উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে বহুমুখী পদক্ষেপ। এ কারণে অপার সম্ভাবনা সত্ত্বেও পর্যটনের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন কখনও আসেনি বলে মনে করেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। অবশেষে
বহুল আকাঙ্ক্ষিত পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। বিমান ও পর্যটন মন্ত্রালয়ের পক্ষ থেকে এ-সংক্রান্ত টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
পর্যটক পরিসংখ্যান প্রণয়নে আসছে সফটওয়্যার :পর্যটনের উন্নয়নে পরিসংখ্যানের কোনো বিকল্প নেই। অথচ দেশে পর্যটকের কোনো সঠিক তথ্য বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। অবশেষে বিদেশি পর্যটক পরিসংখ্যান তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সফটওয়্যারের মাধ্যমে এ-সংক্রান্ত হিসাব করা হবে। অ্যাডভান্সড প্যাসেঞ্জারস ইনফরমেশন সিস্টেম (এপিআইএস) নামে নতুন একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিদেশি পর্যটকদের পরিসংখ্যান তৈরি করা হবে। মূলত বিমানে ভ্রমণকারী অতিথিদের তথ্যগুলো এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে। স্থলবন্দরগুলোতেও এটি দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে আগামী তিন মাসের মধ্যে বিদেশি পর্যটকের হিসাব তৈরির পথে চূড়ান্তভাবে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। এদিকে জাতীয় পর্যটন সংস্থা বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডও (বিটিবি) পর্যটকের পরিসংখ্যান তৈরিতে উদ্যোগ নিয়েছে। সংস্থাটি ‘ওয়েব পোর্টাল অ্যান্ড ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় বোর্ডের নতুন ওয়েব পোর্টাল তৈরি হবে। এ-সংক্রান্ত কাজ পেয়েছে ‘বিজনেস অটোমেশন’ নামে একটি আইটি ফার্ম।
নতুন দুটি আইন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে :ট্যুর অপারেটরদের পরিচালনা ও বিকাশের লক্ষ্যে আসছে নতুন আইন। এ আইনের ফলে নিবন্ধন সনদ ব্যতীত ভবিষ্যতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিয়ে কোনো ট্যুর পরিচালনা করতে পারবেন না পর্যটন উদ্যোক্তারা। একই সঙ্গে ট্যুর গাইডদেরও নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসছে সরকার। ফলে ইচ্ছেমতো ‘যেমন-তেমন’ সেবা দেওয়ার সুযোগ শেষ হয়ে আসছে। চলতি মাসে আইনটি মন্ত্রিসভায় উঠবে বলে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। একই সঙ্গে পর্যটন খাতের একমাত্র সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনকে যুগোপযোগী করতে প্রণীত হচ্ছে ‘বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন আইন, ২০১৯’। এ আইনও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এ আইনের ফলে পর্যটন খাতের সরকারি এই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আরও কার্যকর ও গতিশীল হবে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।
পর্যটন দিবসের কর্মসূচি :বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি) ও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন (বিপিসি) বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। বিপিসি ও বিটিবির আয়োজনে আগামীকাল সকাল সাড়ে ৮টায় একটি সাইকেল র্যালি অনুষ্ঠিত হবে। র্যালিটি মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে শুরু হয়ে ফার্মগেট-কারওয়ান বাজার-হাতিরঝিল-মগবাজার হয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এসে সমাপ্ত হবে। এদিন সকাল ১০টায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। পর্যটন বিচিত্রার আয়োজনে আজ বৃহস্পতিবার থেকে রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় শুরু হচ্ছে এশিয়ান ট্যুরিজম ফেয়ার। এ ছাড়া বিটিবির পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ট্যুরিস্ট সোসাইটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ট্যুরিজম স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান থাকবে।