প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরও এক ধাপ উচ্চতায় উন্নীত হলো বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্নেষকরা। বিশেষ করে জ্বালানি সহযোগিতা, দু’দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি, ঋণ সহায়তা এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সভায় প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ ও ওই ভাষণে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং বহুত্ববাদের প্রসঙ্গ উপস্থাপনকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন বিশ্নেষকরা। ভারত সফরের তৃতীয় দিন গতকাল শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। এ বৈঠক ঘিরে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। শেষ পর্যন্ত সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের মধ্য দিয়ে বৈঠক শেষ হয়েছে। বৈঠকের পর প্রকাশিত যৌথ ঘোষণায় দেখা যায়, দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়গুলো উঠে এসেছে। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং এ ব্যাপারে সম্ভব সব ধরনের সহযোগিতারও আশ্বাস দিয়েছেন। ফলে সার্বিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফর দুই দেশের যৌথ সহযোগিতার ঐতিহাসিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করেছে, সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান সমকালকে বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যে বাক্যটি বলেছেন, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এখন দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বের সামনে বড় উদাহরণ। এখন দুই দেশের সম্পর্কের সোনালি যুগ চলছে। এ প্রেক্ষাপটে একবাক্যে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের দিল্লি সফর দু’দেশের সম্পর্ককে আরও এক ধাপ উচ্চতায় এগিয়ে নিয়ে গেল। এ সম্পর্কের কারণেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এখন অমীমাংসিত ইস্যু আর নেই বললেই চলে। সীমান্তে হত্যা এখন একেবারেই কমে গেছে। আগে যেখানে বছরে একশ’র বেশি হত্যার ঘটনাও ঘটেছে, সেখানে গত বছর মাত্র তিনজন নিহত হয়েছে। গত ১০ বছরে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও পরিস্থিতির এ উন্নয়ন অনেক বড় অর্জন। আর একটা অমীমাংসিত ইস্যু হচ্ছে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। সেটাতেও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কখনও না করেনি। প্রক্রিয়াগত কারণে এ ধরনের চুক্তির ক্ষেত্রে সময় লাগে। এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। তিনি আরও বলেন, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুই সম্পর্কের ভেতরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দু’দেশের মধ্যে জ্বালানি সহযোগিতা, বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি, লাইন অব ক্রেডিটের অর্থ ব্যবহার এবং দু’দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে- এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফেনী নদীর পানি ত্রিপুরায় নেওয়ার ব্যাপারে আরও আগে থেকেই দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা ছিল, এবারের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের মধ্য দিয়ে সেটা আনুষ্ঠানিকতা পেয়েছে। সার্বিকভাবে এ বৈঠক বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এবারের দিল্লি সফরের দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, তিনি সেখানে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সভায় বক্তব্য দিয়েছেন। তার এ বক্তব্য অত্যন্ত সময়োপযোগী ছিল। তিনি আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির কথা বলেছেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি ও বৈষম্য কমানোর বিষয়টি সামনে এনেছেন। একই সঙ্গে বহুত্ববাদের কথা বলেছেন। তার উচ্চারণ সময়ের বিবেচনায় সাহসীও। এ ফোরামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অংশগ্রহণ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। দ্বিতীয়ত, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক। এ বৈঠকে দু’দেশের স্বার্থসংশ্নিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেগুলো স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে, বিশেষ করে জ্বালানি ও বাণিজ্য খাতে সহযোগিতার সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাবে। এ বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির প্রসঙ্গটি উঠবে না, সেটা আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল। এ বৈঠকে সেটা ওঠা বা না ওঠার বিশেষ কোনো গুরুত্বও নেই। কারণ, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একমত এবং এটা কেন ঝুলে আছে, সেটা সবারই জানা। অতএব, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে সব জটিলতা নিরসন হয়ে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হবে, সে প্রত্যাশা রয়েছে।
অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন আরও বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দু’দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে বিষয়টি এবারের বৈঠকে বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে, এটা খুবই ইতিবাচক। যৌথ ঘোষণায় রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে আলোচনার কথাও এসেছে। এর ফলে এ সংকট সমাধানে ভারতের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। এটাও বাংলাদেশের জন্য খুবই ইতিবাচক।