
মুহাম্মদ কাইসার হামিদ, কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধিঃ
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে কর্মরত কিশোরগঞ্জ জেলার কৃতী সন্তান মো. শাহাদত হোসেন কবির বাংলাদেশ সরকারের উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। রোববার (৭মার্চ) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন নিয়োগ-১ অধিশাখার উপসচিব মুহাম্মদ আবদুল লতিফ এর স্বাক্ষরিত এক সরকারি আদেশে এ পদোন্নতি দেয়ার তথ্য জানা যায়।
এ সু-খবরটি এলাকায় ছড়িয়ে পরলে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব ইয়াছির মিয়া, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইমতিয়াজ বিন মুছা জিসান, পৌর মেয়র সৈয়দ হাসান সারওয়ার মহসিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মো. জিল্লুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মো. এনামুল হল, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আলী আকবর খাঁন, গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো.আব্বাস উদ্দিন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. এনামুল হক আবুবক্কর, উপজেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ কাইসার হামিদ সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাঁকে পৃথক পৃথক ভাবে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।
কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার নিভৃত পল্লী থেকে উঠে আসা শাহাদত হোসেন কবির । তাঁর পৈত্রিক নিবাস কুলিয়ারচর উপজেলার গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের বড়চারা গ্রামে। ১৯৭৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. মোজাম্মেল হক। শাহাদত কবিরের মায়ের নাম শামসুন্নাহার।
শাহাদত হোসেন কবির শৈশবে স্থানীয় বড়চারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর কয়েক মাস স্থানীয় লক্ষ্মীপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়নের পর তিনি বাজিতপুর উপজেলার ভাগলপুরস্থ আফতাব উদ্দিন স্কুল এন্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ওই স্কুল থেকে থেকে তিনি ১৯৯৪ সালে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৯৬ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং পরে একই বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে এমএ পাশ করেন।
২০০৬ সালে ২৬তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষা ক্যাডারের চাকুরিতে যোগ দিয়ে শাহাদত কবির নেত্রকোণা সরকারি কলেজে আড়াই বছরের কিছু বেশি সময় শিক্ষকতা করেন। এরপর বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রের ডাকে ২৭তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন ক্যাডারের চাকুরিতে যোগদান করেন। ২০০৮ সালের নভেম্বরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে প্রশাসনে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর জয়পুরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করেন। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে তিনি রাজশাহীর পবা উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যথাক্রমে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলা ও ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে কাজ করেন। এরপর থেকে এখন অবধি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে কর্মরত আছেন।
প্রশাসনের চাকুরিতে এক যুগ সময়ের মধ্যে শাহাদত হোসেন কবির বেশ কিছু অসাধারণ অর্জনের জন্য আলোচিত হয়েছেন। বিশেষ করে ২০১৪-১৫ সালে রাজশাহী জেলার পবা উপজেলা ভূমি অফিসে তাঁর চালু করা উদ্ভাবনী সেবা মডেল ‘মাটির মায়া’ সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সহকারী কমিশনার-ভূমি (এসিল্যান্ড) হিসেবে কাজ করার সময় তিনি তাঁর অফিসে আগত সেবাপ্রার্থীদের বসার জন্য অফিসের নিচে একটি টিনশেড বানিয়ে নাম দিয়েছিলেন ‘মাটির মায়া’। সকালে এসে ঘণ্টাখানেক সেখানেই বসতেন তিনি। এর আগে গ্রামের সহজ সরল মানুষ সেবা নেওয়ার জন্য ওই ভূমি অফিসে ঢুকতে গেলেই দালালদের খপ্পরে পড়তে হতো। কিন্তু পবার এই এসিল্যান্ড মাটির মায়ায় বসে পালটে দেন চিত্র। তিনি সরাসরি সেখানে মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনে তাৎক্ষণিক সেবা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এই ব্যবস্থার সাফল্য মিডিয়ার নজরে পড়ে। পাশাপাশি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এটাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে দেশের অন্যত্র বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেয়। এর ফলে সারা দেশে সমস্ত এসিল্যান্ড অফিসে মাটির মায়া ছড়িয়ে পড়েছে, যার অগ্রপথিক ছিলেন পবার সেই এসিল্যান্ড।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে দুটি উপজেলায় ভূমি সেবার মানোন্নয়নের পাশাপাশি মাদক, বাল্যবিবাহ, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতি দূরীকরণসহ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ উন্নয়ন, খেলাধুলা, যুব উন্নয়ন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন তিনি। বিশেষ করে দেলদুয়ার উপজেলায় সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতায় এক দিনে আড়াই লক্ষ গাছ লাগিয়ে তিনি আরো এক দফা সারাদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। তিনি মাটি ও মানুষের সাথে মিশে কাজ করে এলাকার মানুষের মন জয় করে নেন। সব শ্রেণিপেশার মানুষের জন্য তাঁর দুয়ার ছিল খোলা। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন শেষ আশ্রয়। তাঁর বিদায়ের দিনে উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ গরিব-দুঃখী সাধারণ মানুষ চোখের জল ফেলেছিলেন।