আলমগীর হোসাইন, কুড়িগ্রাম:
কুড়িগ্রামের উলিপুরে ধান-চাল ও গম ক্রয়ে খাদ্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি এসব পণ্য ক্রয়ের কথা থাকলেও, তা কেনা হচ্ছে না। ভারপ্রাপ্ত খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা (ওসি এলএসডি) মনোয়ারুল ইসলামের একটি আস্থাভাজন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে, বিভিন্ন প্রকল্পের ডিও ( ডেলিভারি অর্ডার) সমন্বয় করে এসব পণ্য ক্রয় করছেন বলে গুরুত্বর অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও গত ২ সপ্তাহ আগে ওই গুদাম কর্মকর্তার পছন্দের ৩ টি পরিত্যাক্ত রাইস মিলের সাথে জেলা খাদ্য কর্মকর্তা ধান ছাটাইয়ের চুক্তি করেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ২ জন মিল মালিক চুক্তির ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানা গেছে। এমন লাগামহীন দূর্নীতির কারনে সরকারের ক্রয় অভিযান ভেস্তে যেতে বসেছে। এসব দূর্নীতির সাথে উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক ফজলুল হক একমত না হওয়ায় তাকে নানা ভাবে হেনস্ত করার পর, জরুরী ভিত্তিতে বদলী করা হয়। ওই সিন্ডিকেট গত সোমবার ১ জুলাই ফজলুল হককে তার অফিসে দীর্ঘ সময় তালাবদ্ধ করে রাখে।
এ ঘটনায় উপজেলার ধান চাষী ও সাধারণ মিল মালিকদের মাঝে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিস সুত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে প্রথম দফায় উপজেলায় ৬‘শ ৩৭ মেট্রিক টন ধান বরাদ্দ আসে। প্রশাসন ও শাসক দলের টানা পোড়নের কারনে, বেশ বিলম্বে দুই দফায় লটারি অনুষ্ঠিত হয়। ততদিনে প্রকৃত কৃষকরা তাদের কষ্টার্জিত ফসল, বাজারে পানির দরে বিক্রি করে দেয়। এদিকে, লটারি অনুষ্ঠানের পর পর খাদ্য গুদাম কেন্দ্রিক সরকারী দলের পরিচয়ে গড়ে উঠা একটি সক্রিয় সিন্ডিকেট, নির্বাচিত কৃষকদের জাতীয় পরিচয় পত্র ও কৃষি কার্ড সংগ্রহ করে গুদামে ধান ঢুকানোর ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে উঠে। অন্যদিকে, জেলা খাদ্য কর্মকর্তা মহিবুল হক অত্যন্ত গোপনে নিয়মবর্হিভূত ভাবে ১‘শ মেট্রিক টন ধান ছাটাইয়ের জন্য ‘রাজা-রানা’ চাউল কল ৩০ মেট্রিক টন, ‘রিফাত’ চাল কল ৩০ মেট্রিক টন ও ‘আজাদ’ চাল কল এর সাথে ৪০ মেট্রিক টন ধান ছাটাইয়ের জন্য চুক্তি করেন। কিন্তু চুক্তির ২ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও গত শনিবার সরেজমিনে ‘রিফাত’ চাল কল ও ‘আজাদ’ চাল কলে গিয়ে দেখা যায় এসব মিলে বয়লার, হাউজ, চাতাল, গুদামঘর দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তবে সেখানে ছাটাইয়ের ধানের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজাদ চাল কলের মালিক আবুল কালাম আজাদ হতবাক হয়ে বলেন, ধান ছাটাইয়ের জন্য চুক্তিবদ্দ হয়েছি এমন খবর আপনাদের মাধ্যমে জানলাম। রিফাত চাল কলে গিয়ে দেখা যায় মিলটি দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যাক্ত রয়েছে। স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি মিল মালিক মাহাবুবার রহমান তার ছোট ভাই সালু মিয়ার কাছে মিলটি বিক্রি করে দিয়েছেন। রাজা-রানা চাউল কলটিতে ছাটাইয়ের কোন ধান পাওয়া যায়নি। এদিকে, উপজেলায় ধান ছাটাইয়ের জন্য সচল মিল থাকলেও পরিত্যাক্ত মিলের সাথে গোপনে চুক্তি করায় জেলা খাদ্য কর্মকর্তার ভূমিকা নিয়েও সাধারণ মিলারদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয় দূর্নীতির মাধ্যমে ক্রয় করা এসব পুরাতন চাল দ্রæত গুদাম থেকে অন্য গুদামে স্থানন্তরের জন্য জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক প্রোগ্রাম দিয়েছেন !।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাদ্য বিভাগের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, উলিপুর খাদ্য গুদামে সক্রিয় সিন্ডিকেটটির সাথে গুদাম কর্মকর্তা অবৈধ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছে। ছাঁটাইয়ের বিষয়টি গোপন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ওই কর্মকর্তা নির্বাচিত কৃষকদের জাতীয় পরিচয় পত্র নিয়ে কাগজ কলমে ধান ক্রয় দেখিয়ে ডবিøউ.কিউ.এস.সি‘র মাধ্যমে সিন্ডিকেটের হাতে টাকা তুলে দেয়। এরপর তারা ধান না কিনে ১৬ থেকে ১৭ টাকা কেজি দরে পুরাতন চাল বাজার থেকে কিনে এবং কিছু প্রকল্পের ডিও সমন্বয়ের মাধ্যমে সরবরাহ দেখিয়ে মোটা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এভাবে প্রতিমণ ধানের ১ হাজার ৪০ টাকা ও ছাটাই বাবদ ৩০ টাকা সহ মোট ১ হাজার ৭০ টাকার বিনিময়ে সিন্ডিকেটটি নি¤œ মানের ২৬ কেজি দরের চাল খাদ্য গুদামে দিচ্ছে। এতে প্রতিমণে তাদের লাভ হচ্ছে ৬‘শত ২৮ টাকা। এভাবে ১‘শ মে.টন ধান ছাটাইয়ের মাধ্যমে সিন্ডিকেটটি ১৩ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিবে।
এদিকে, মিল মালিকদের সাথে নতুন চাল ক্রয়ে চুক্তিবদ্দ হলেও, একই পদ্ধতিতে বাজার থেকে নি¤œমানের চাল সংগ্রহ করে গুদামে দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি।
১‘শ ৩১ মেট্রিক টন গম ক্রয়ের জন্য লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচিত করা হয়। গত জুনের ২৬ তারিখ পর্যন্ত কৃষকদের কাছ থেকে মাত্র ৫৪ মেট্রিক টন গম সংগ্রহ দেখানো হয়। পরে অবশিষ্ট ৭৭ মেট্রিক টন গম অদৃশ্য যাদুর বলে ৩ দিনে ক্রয় দেখানো হয়।
খাদ্যগুদাম সংশ্লিষ্ট অভিযোগ, বর্তমানে খামালকৃত বস্তার মাঝখানে পুরাতন গম, আর চতুর্দিকে নুতুন গমের বস্তা দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কাগজ কলমে ১‘শ ৩১ টন গম ক্রয় দেখানো হলেও বাস্তবে সেখানে মজুদ কম। এভাবে লাগামহীন এ দূর্নীতির হিস্যা পাচ্ছেন উপজেলা ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা আব্দুস সালাম, জেলা খাদ্য কর্মকর্তা মহিবুল হক, বিভাগীয় খাদ্য কর্মকর্তা রায়হানুল কবির। এসব অসাদু কর্মকর্তার কারণে সরকারের সংগ্রহ অভিযানের উদ্দেশ্য কার্যতঃ ব্যার্থ হচ্ছে ফলে প্রতিনিয়ত ধানের বাজারে ধস নামছে।
ভারপ্রাপ্ত খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আমার এখানে কোন অনিয়ম হয় না। ৫৪ মে.টন গম গত ২৬ জুন পর্যন্ত সংগ্রহ হলেও মাত্র ৩ দিনের ব্যবধানে ৩০ জুন অবশিষ্ট ৭৭ মে.টন গম কিভাবে সংগ্রহ হল জানতে চাইলে তিনি নির্বিকার ভূমিকা পালন করেন।
উপজেলা দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুস সালাম মিয়া অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করে ধান ছাঁটাইয়ের জন্য চুক্তিবদ্দ মিলের তালিকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মহিবুল হকের সাথে কথা হলে তিনি এ প্রতিবেদক কে বলেন, আগে বললে এসব ব্যাপারে খতিয়ে দেখা যেত। তবে তিনি এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশ না করার জন্য বলেন।
রংপুর বিভাগীয় আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক রায়হানুল কবিরের সঙ্গে এসব অনিয়মের বিষয়ে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি দূর্নীতির বিষয় গুলো এড়িয়ে যান।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানমের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, নীতিমালা অনুযায়ী মিল পরিদর্শনের পর ছাঁটাইয়ের জন্য মিল মালিকদের সাথে চুক্তি হবে। এখানে নীতিমালার যদি কোন ব্যাত্যয় ঘটে তাহলে অবশ্যই ব্যাবস্থা গ্রহন করা হবে।