মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৪৭ অপরাহ্ন
দশ বছর আগে বাকপ্রতিবন্ধী সিরাজের সঙ্গে বিয়ে হয় শামসুন্নাহারের। বিয়ের পর তাদের সংসারে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। মেয়ের নাম রাখা হয় মঞ্জু। মঞ্জুর বয়স এখন ৬। পেশায় রাজমিস্ত্রির সহকারী সিরাজ প্রতিদিন কাজে চলে যাওয়ার সুযোগে পাশের বাসার বিদ্যুৎমিস্ত্রি আবদুল মান্নান ওরফে সোহেলের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে শামসুন্নাহার। একদিন সোহেলের হাত ধরে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান তিনি।
স্ত্রী-সন্তানের শোকে অনেকটা পাথর হয়ে যান সিরাজ। স্ত্রী চলে যাওয়ার পর থেকে সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলো এলাকার মেসে ভাড়া থাকতেন তিনি। সময় পেলেই খুঁজতে যেতেন একমাত্র মেয়েকে। তবে দুর্ভাগ্য এই বাকপ্রতিবন্ধী মানুষটির। মেয়েকে দেখতে গিয়েই ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে প্রাণ হারান তিনি। শনিবার সিদ্দিরগঞ্জের মিজমিজি আল আমিন নগরে গণপিটুনিতে মারা যান সিরাজ।
নিহত সিরাজ সিদ্ধিরগঞ্জে সাইলো এলাকার আ. রশিদ মণ্ডলের ছেলে। তার গ্রামের বাড়ি ভোলার লালমোহন থানার মুগিয়া বাজার এলাকায়।
নিহত সিরাজের ছোট ভাই আলম ও কালাম বলেন, আট মাস আগে ভাবি শামসুন্নাহার তার ভাইকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কিছুদিন আগে তালাকের নোটিশ পাঠায়। এরপরই সিরাজ খবর পান, মিজমিজি এলাকার মুজিববাগ এলাকায় সোহেল তার স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছে। এর পর থেকেই প্রায়ই সে সকালের দিকে মেয়ে মঞ্জুকে একনজর দেখার জন্য ওই এলাকায় ঘোরাঘুরি করত।
আলম আরও জানান, ঘটনার দিন শনিবার সকাল ১০টার দিকে এলাকার এক লোক তার মোবাইলে ফেসবুকে দেখান যে, একজন লোককে ছেলেধরা সন্দেহে মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। নিহতের ছবি দেখে আমি ভাইকে চিনতে পারি। এরপর পুলিশের উপস্থিতিতে ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করি।
এদিকে এ ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এসআই সাখাওয়াত মৃধা বাদী হয়ে ৬৭ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও তিনশ’ থেকে চারশ’ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় ১৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। যাদের মধ্যে ঘটনাস্থলের পাশে থাকা আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক মো. রেদওয়ান রয়েছেন। রেদওয়ান ওই মামলার প্রধান আসামি। তিনিই প্রথম সিরাজকে মারধর করেন।
তবে রেদওয়ান পুলিশকে জানিয়েছেন, ঘটনার দিন সকালে স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়াকে (৬) আদর করে কোলে তুলে নেয় সিরাজ। কারণ জিজ্ঞেস করলে সিরাজ আকার-ইঙ্গিতে কিছু বোঝানোর চেষ্ট করে। বিষয়টি বুঝতে না পেরে স্থানীয় লোকজন সিরাজকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিলে সে ঘটনাস্থলেই মারা যায়।
ঘটনার পর শিশু সাদিয়া পুলিশকে জানিয়েছে, লোকটি (সিরাজ) তাকে প্রায়ই চিপস কিনে দিত। আদর করত।
এদিকে রোববার সকালে সিরাজের লাশ সিদ্ধিরগঞ্জের সাইলো গেট এলাকায় নিয়ে এলে স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। লাশ ঘিরে থাকা এলাকাবাসী ও তার মেজ ভাই আলম সিরাজ হত্যাকাণ্ডকে পরিকল্পিত বলে উল্লেখ করেন। তারা সিরাজ হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবিতে মিছিলও করেন।
এদিকে সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী নতুন মহল্লায় মানসিক রোগী শারমিনকে ছেলেধরা সন্দেহে মারধরের ঘটনায় তার মা তাসলিমা বেগম বাদী হয়ে ২০ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও দেড়শ’জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেন। এর মধ্যে এজাহারনামীয় ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
ফতুল্লায় ছেলেধরা সন্দেহে নারীসহ দু’জনকে গণপিটুনি: ফতুল্লায় ছেলেধরা সন্দেহে শনিবার রাতে এক ফুল ব্যবসায়ী এবং রোববার সকালে এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী।
আহতরা হলেন- ফুল ব্যবসায়ী রাসেল মিয়া (৪৫) ও শেফালী বেগম (২৩)। এর মধ্যে রাসেল ঢাকার জুরাইন দারোগাবাড়ি রোডের নুর হোসেনের ছেলে এবং শেফালী কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি থানার মো. আশরাফ চৌধুরীর স্ত্রী। তার স্বামী ঢাকায় চাকরি করেন। দুটি ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফতুল্লার তক্কারমাঠের বটতলা এলাকার গার্মেন্ট কর্মী রশিদ মিয়ার ছেলে আকতার (৯) স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় শেফালী তার হাত ধরে টানাটানি করে। এ সময় আকতার চিৎকার করলে স্থানীয়রা জড়ো হয়ে শেফালিকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটুনি দেয়।
ফতুল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসলাম হোসেন সমকালকে জানান, আটক শেফালী বেগমের কথাবার্তা অসংলগ্ন ছিল। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্যদিকে শনিবার রাতে ফতুল্লার লালখা এলাকার বাসিন্দা শাহজাহান গাজীর মেয়ে প্রিয়া (৬) দোকান থেকে বিস্কুট কিনে বাসায় ফেরার পথে রাসেল তাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় আশপাশের লোকজন ছেলেধরা সন্দেহে রাসেলকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে।
তবে রাসেলের স্ত্রী নাসিমা রাত ১১টায় ফতুল্লা মডেল থানায় এসে তাকে শনাক্ত করেন। তিনি জানান, তার স্বামী ঘুরে ঘুরে ফুল বিক্রি করেন। রাসেল ছেলেধরা নন।
বিভ্রান্ত না হতে পুলিশ সুপারের ব্রিফিং: রোববার নগরের চাষাঢ়া শহীদ মিনারে ছেলেধরা ইস্যুতে ব্রিফিং করেন পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ। তিনি বলেন, ছেলেধরা গুজবে কেউ কান দেবেন না। আইন হাতে তুলে না নিতে সবাইকে অনুরোধ করে তিনি বলেন, কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে তাকে আটকে রেখে পুলিশে সোপর্দ করবেন। তা না হলে এ ধরনের ঘটনায় মামলার আসামি হয়ে যাবেন।
তিনি জানান, এ ধরনের ঘটনা রোধে পুলিশ সচেতনতার জন্য মাইকিং করছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।