টেনশন করিস না শান্তা। ডাক্তার বলেছেন, শিগগিরই ভালো হয়ে যাবি তুই’- ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফাতেমা আক্তার শান্তাকে আইসিইউতে এই বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন হালিমা আক্তার রাফা। শুনে মুখের মাস্ক খানিকটা সরিয়ে তার হাত চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ফাতেমা বলেছিলেন- ‘দোস্ত, আমার ভালো লাগছে না। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বুক ব্যথা করছে।’ তার পর আর কোনো কথা হয়নি তাদের মধ্যে। হবেও না আর কোনোদিন।
মোবাইল ফোনে এ প্রতিবেদককে কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন হালিমা। তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একসঙ্গেই থাকতাম আমরা। হাজারীবাগ এলাকায় পাশাপাশি ভবনে থাকি। ঘর থেকে বেরিয়ে শান্তাদের বাসার নিচে এসেই ডাকতাম ওকে।’
আরেক বন্ধু শারমীন হক বন্যা জানালেন, ফাতেমা ছিলেন অনেক শান্ত মেয়ে। সহজে বলতেন না সব কিছু। নিবিড় ঘনিষ্ঠতা ছিল তিন বন্ধুর মধ্যে। কিন্তু নিজের কষ্টগুলো শারমীন আর হালিমার কাছ থেকে চেপে রাখতেন তিনি। গতকাল সোমবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক আবেগঘন স্ট্যাটাসে শারমীন তাদের শেষ সাক্ষাতের বিবরণ তুলে ধরে লিখেছেন, ”বিশ্বাস কর দোস্ত, একবারের জন্যও বুঝতে পারিনি যে এটাই শেষ কথা তোর সাথে। নয়তো আরও কিছুক্ষণ তোর সাথে কথা বলতাম। শেষবারের মতো তোরে একটু ছুঁয়ে দেখতাম। আচ্ছা তুই কেন গেলি আমাদের একা করে? কাল না ফ্রেন্ডশিপ ডে ছিল? এই ছিল তোর দেওয়া গিফট?”
গত দুই বছর সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সন্ধ্যা অবধি কোচিং, কলেজ, ঘুরে বেড়ানো- সব কিছুতেই তারা তিনজন একসঙ্গে ছিলেন। শুধু ফাতেমার পরিবার নয়, প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে তাই হালিমা আর শারমীনও ভেঙে পড়েছেন।
রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তারা তিনজন। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে জিগাতলার জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত রোববার বিকেল সাড়ে ৪টায় মারা গেছেন ফাতেমা আক্তার শান্তা। সোমবার সকাল ৯টার দিকে গাজীপুরের কাশিমপুরে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয় তাকে।
চাচা মো. নাসির উদ্দিন জানান, ফাতেমার বাবা এবং একমাত্র ভাইও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার মাও জ্বরে আক্রান্ত। তাই ফাতেমার চাচাতো ভাই রুবেল, তার স্ত্রী নুসরাত, দাদি ও খালা গ্রামের বাড়িতে তার মৃতদেহ নিয়ে যান।
এদিকে রোববার সকালেই রাজধানীর শ্যামলীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের ৪২১ নম্বর ওয়ার্ডে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ফাতেমার বাবা মোহাম্মদ শামছুদ্দিন মিয়া ও ভাই তানভীর আহমেদকে ভর্তি করা হয়। একইসঙ্গে ফাতেমার মা আকলিমা বেগমকেও একই হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষার ফলাফলের পর জানা যাবে তিনিও আক্রান্ত হয়েছেন কি-না।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের ‘স্টাফ’ ফাতেমার বাবা শামছুদ্দিন। তার ভাই এই কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। দুই ভাইবোনই লেখাপড়ায় ভালো ছিল বলে জানান ফাতেমার বন্ধুরা। দুই সন্তানকে বুকে আগলে রাখতেন বাবা-মা দু’জনেই।
ফাতেমার শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রতীক বলেন, একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে পরিবারের সবাই বাকরুদ্ধ। আমরাও এ মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না।
গত মঙ্গলবার ফাতেমার জ্বর হলে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। পরে শরীর খানিকটা ভালোও হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার থেকে জ্বর বাড়লে সন্ধ্যায় এক বেসরকারি হাসপাতালে তার ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষা করানো হয়। শুক্রবার ফলাফলে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। শনিবার সকালে চাচাতো ভাই রুবেলের তাগিদে রাজধানীর তিনটি হাসপাতালে নেওয়া তাকে। কিন্তু শয্যা না পাওয়ায় জিগাতলার জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করানো হয়। রোববার বিকেলে তার মৃত্যু ঘটে।